প্রিয় ফরিদপুর.কম

ফরিদপুর জেলার স্মরণীয় ব্যক্তিবর্গ >> অম্বিকাচরণ মজুমদার

...

অম্বিকাচরণ মজুমদার

  • জন্ম সালঃ ১৮৫১ সালের ৬ জানুয়ারী
  • জন্ম স্থানঃ মাদারীপুর জেলার রাজৈর থানাধীন সেনদিয়া গ্রাম
  • মৃত্যু সালঃ ১৯২২ সালের ২৯ শে ডিসেম্বর

অম্বিকাচরণ মজুমদার ১৮৫১ সালের ৬ জানুয়ারি তৎকালিন ফরিদপুর বর্তমান মাদারীপুর জেলার অর্ন্তগত সেনদিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা রাধা মাধব ও মাতা শুভদ্রাদেবী। অম্বিকাচরণ ছিলেন পিতা মাতার সপ্তম সন্তান। পিতা ব্যাধিগ্রস্থ ও সংসার বিমুখ হওয়ায় তার মাতা সুভদ্রাদেবীকে পুরো সংসারের দায়িত্ব একাই পালন করতে হতো। এমনি বিরাট সংসার, তদুপরি এতবড় সংসারের বোঝা, এই নিয়ে তাকে নানান দুর্ভোগ পোহাতে হতো। অম্বিকাচরণের পূর্ব পুরুষের আধিবাস ছিল খুলনার মূলঘরে। অম্বিকাচরনের পিতা রাধামাধব সংস্কৃত ও ফারসীতে পারদর্শী ছিলেন। মাতা শুভদ্রাদেবী ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতি; তাকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে বৈরাগ্য ব্যাধিগ্রস্থ স্বামী ও পুত্রদের কলহপূর্ণ সংসারের ভার বহন করতে হতো। অম্বিকাচরণ অত্যন্ত চঞ্চলমতি ছিলেন; একগুয়ে ও অবাধ্য। এ পুত্রকে আয়ত্বে আনতে নানা পন্থা অবলম্বন করতে হতো তার মাকে। অম্বিকাচরণ মায়ের প্রতি বরাবরই দুর্বল ছিলেন। মাকে তিনি গভীর শ্রদ্ধাভক্তি করতেন। পরিনত বয়সে অম্বিকাচরণ ফরিদপুরে নিজ বাসায় তার মাকে নিয়ে আসেন। শেষ জীবনে এই পুত্রের কাছে শান্তিতে দিন কাটাতে থাকেন তার মা। মায়ের মৃত্যুর পর তার স্মৃতি রক্ষার্থে বাড়িতে একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন অম্বিকাচরণ।

শৈশবে অম্বিকাচরনের গ্রামের পাঠশালায় লেখাপড়া শুরু। অত্যন্ত চঞ্চলমতি হওয়ায় ভাইয়েরা তার লেখাপড়ার ব্যাপারে সন্ধিহান ছিলেন; কিন্ত মায়ের অনুরোধে ১২৬৬ বঙ্গাব্দে অম্বিকাচরণ বরিশালের একটি স্কুলে ভর্তি হন। অল্পকালে শিক্ষক মহোদয়গণ তার বুদ্ধির পরিচয়ে মুগ্ধ হন। প্রধান শিক্ষকের সংস্পর্শে এসে অম্বিকাচরন বার্ক, মিল্টন, অ্যার্নাল্ড, এডিসন, সেক্সপিয়ার, গিবন প্রমুখ বিশ্ব বিখ্যাত লেখকদের গ্রন্থসমূহ পাঠে আগ্রহী হন। এভাবেই তিনি ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। ১৮৬৯ সালে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাশ করেন, এরপর কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন। ১৮৭৪ সালে অষ্টম স্থান অধিকার করে প্রথম বিভাগে বিএ পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি বিএ এলএলবি ও এমএ পাশ করেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আর্শীবাদ পুষ্ট হয়ে তিনি আইন পেশায় যোগদান করেন। ১৮৭৯ সালে অম্বিকাচরণ মজুমদার ফরিদপুর জজ কোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি ছিলেন ফরিদপুরের একমাত্র উচ্চ শিক্ষিত আইনজীবী। বলা বাহুল্য তদানিন্তন সময়ে উল্লেখযোগ্য বাঙ্গালি মাত্রই কোলকাতায় কর্মক্ষেত্র বেছে নিতেন এবং কোলকাতা তখন আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র হওয়ায় সেথায় অধিকাংশ শিক্ষিত জনেরাই পাড়ি জমাতেন। কিন্তু অম্বিকাচরনই ছিলেন একমাত্র ব্যতিক্রম, তিনি কোনদিন কোলকাতায় বসবাসের কথা কল্পনাও করেননি। তাই ফরিদপুরে আইন পেশা তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথেই শুরু করেছিলেন। তার সহচর্যে ছিলেন অশ্বিনী দত্ত, বৈকুণ্ঠ সেন প্রমুখ। উকিল পেশায় যোগদান করে এখানে তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। উকিল হিসাবে খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করায় অনেকেই তখন তাকে কোলকাতা হাইকোর্টে গিয়ে প্রাকটিস করার পরামর্শ দেন। কিন্তু ফরিদপুরকে তিনি প্রাণের চেয়ে ভালবাসতেন। স্বীয় কর্মস্থল ত্যাগ করে কোলকাতায় যেতে কখনই রাজি হননি। এখানেই তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অবস্থান করেন এবং ফরিদপুরে উকিল সভার প্রতিষ্ঠা, তার বৈপ্লবিক পরিবর্তনসহ নানাবিধ সংস্কার মূলক কাজের সাথে সম্পৃক্ত হন। যার জন্য আজও ফরিদপুরবাসী তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে।

১৮৭৫ সালে ১৩ জন সদস্য নিয়ে তিনি ফরিদপুর বার লাইব্রেরী ও লাইব্রেরী পাঠাগার গঠন করেন। ঈশান চন্দ্র মৈত্র ও দ্বীগম্বর স্যানাল যথাক্রমে সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৮৮০ সালে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। দিগম্বর স্যানাল সম্পাদক নির্বাচিত হন। বারে গঠনতন্ত্র প্রণয়নে অম্বিকাচরণের ভূমিকা ছিল অপরীসীম। তৃতীয়বার তিনি নির্বাচনে সভাপতি ও রায় বাহাদুর টিএন চৌধুরী সম্পাদক নির্বাচিত হন। ইত্যবসরে তিনি সরকারের কাছ থেকে ভূমি লীজ নিয়ে রাজেন্দ্র কলেজ বিল্ডিং তৈরীতে হাত দেন। প্রতিষ্ঠাদের মধ্যে ছিলেন ঈশান চন্দ্র মৈত্র, প্রসন্ন কুমার স্যানাল, কামিনী কুমার মুখোপাধ্যায়, তারাপদ চক্রবর্তী, দিগম্বর স্যানাল, দীন-নাথ দাস প্রমুখসহ অম্বিকাচরণ নিজে। ফরিদপুরে উকিল বারের প্রয়োজনীয় সভাগুলি প্রথমে অনুষ্ঠিত হতো দিগম্বর স্যানাল এর বাড়ীতে, পরে নতুন ভবন নির্মিত হলে যথারীতি এখানে সভা অনুষ্ঠান হতে থাকে। জানা যায় অম্বিকাচরণ মজুমদারের রাজনৈতিক গুরু স্যার সুরেন্দ্র নাথ বন্দোপাধ্যায়ের উত্থান ও সাফল্যের সাথে তিনিও অংশীদার। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা লগ্নে এগিয়ে আসেন রাজা রাম মোহন রায়, রামকৃষ্ণ পরম হংস দেব এবং তার শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ। এই রাজনীতিতে আবির্ভাব ঘটে অম্বিকাচরণ ও তার গুরু সুরেন্দ্র নাথ বন্দোপাধ্যায়ের। সুরেন্দ্র নাথ ১৮৮৩ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস নামে একটি জাতীয় সভার আয়োজন করেন। ১৮৮৯ সালে উমেশ চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে এবং ইউম নামের একজন অবসরপ্রাপ্ত আইসিএস এর সহায়তায় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। স্যার সুরেন্দ্রনাথকে বলা হতো ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রাষ্ট্রগুরু, ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পুরধা, সুরেন্দ্রনাথ এর সহকারী হিসেবে অম্বিকাচরণ কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কংগ্রেসের নীতি ছিল ইংরেজদের সাথে সহযোগিতা করে ভারতীয়দের অধিকার আদায় করা; ১৯১৬ সাল পর্যন্ত সুরেন্দ্রনাথ ছিলেন কংগ্রেসের প্রধান কর্ণধর আর অম্বিকাচরণ ছিলেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জনক। স্যার সুরেন্দ্রনাথের দক্ষিণ হস্ত অম্বিকাচরণ, কংগ্রেসের মুল নেতৃত্বের সাথে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তার এই গৌরবময় ভূমিকার সংগে নিজ এলাকা ফরিদপুরে ছিলেন অবিসংবাদিত কংগ্রেস নেতা ও সমাজ সেবক। বৃট্রিশ ভারতের বাইরে স্বাধীন ভারতের চিন্তা তখন নেতাদের মধ্যে ছিল না। ব্রিটিশকে সহযোগিতা করে রাজনীতি পরিচালিত হবে এই ছিল সেই সময়ের চিন্তাধারা; এই চিন্তা ধারায় ৩১ বৎসর কংগ্রেস পরিচালিত হয়েছে। এই মতের বিশ্বাসী ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ দত্ত, গোকলে রানাদে ও দাদাভাই নওরোজী। অম্বিকাচরণ এই মতেরই অনুসারী একজন গোড়া সমর্থক ও ভারতের স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ একনিষ্ঠ রাজনীতিক। ফরিদপুরে তিনি আইন পেশার পাশাপাশি গুরুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশ সেবায় ব্রতী হন এবং ১৮৮১ সালে পিপলস এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠান ছিল ফরিদপুর ও পূর্ব বঙ্গের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। গুরুর প্রতিষ্ঠিত ভারতসভা এবং শিষ্য প্রতিষ্ঠিত ফরিদপুর পিপলস এসোসিয়েশন এই দুটোই ছিল ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে কংগ্রেসের পূর্বসুরী। পরে অম্বিকাচরণ ফরিদপুর পিপলস এসোসিয়েশনকে ভারতসভার সঙ্গে যুক্ত করেন এবং তিনি তাতে যুক্ত হন। ১৯১৩ সাল থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত তিনি ভারত সভার সভাপতি ছিলেন। ১৯১৯ সালের ৮ এপ্রিল ৬২ নং বহুবাজারে ভারতসভার অভিষেক উদ্ধোধন করে। ১৯১৯ সালে ১৮ ও ২০ মে বর্ধমান বঙ্গ প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সমিতির বার্ষিক সম্মেলন হয়। সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। এই অধিবেশনের প্রাক্কালে সাপ্তাহিক বেঙ্গলীতে লেখা হয় ফরিদপুরের নেতৃস্থানীয় উকিল অম্বিকাচরণ মজুমদার আগামী বৃহস্পতিবার বর্ধমানে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতির আসন গ্রহণ করবেন। অম্বিকাচরন কংগ্রেসের অন্যতম নেতা হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। তার ঐকান্তিক নিষ্ঠা অটল মনোভাব ও দৃঢ়তা দেশের কাছে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত আসন তৈরী হয়েছিল। অম্বিকাচরনের পিপলস এসোসিয়েশনের লক্ষ ছিল রাজনীতির সাথে জনহিতকর কাজ করা, এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি একটানা ১৫ বৎসর আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় রাজবাড়ী হতে ফরিদপুর শহর পর্যন্ত রেল লাইন স্থাপনের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সম্মতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফরিদপুর শহরের উপকন্ঠে ফরিদপুর রেল ষ্টেশন প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই রেল ষ্টেশনের নাম পরিবর্তন করে অম্বিকাচরণ রেল ষ্টেশন করা হয়। স্যার সুরেন্দ্রনাথ ও অম্বিকাচরণ এর যৌথ প্রচেষ্টায় কংগ্রেস ভারতবর্ষের প্রধান রাজনৈতিক দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে এবং ভারতীয়দের আশা আকাঙ্খার প্রতীক হিসেবে কংগ্রেস পরিগণিত হয় এবং এক সময় বিচ্ছিন্নবাদী আন্দোলনে রুপ নেয়। উদারপন্থী ও উগ্রপন্থীদের কবলে পড়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরাগভাজন হয়। কেউ কেউ অস্ত্রের ভাষায় ভারতীয়দের অধিকার আদায়ের পক্ষে মত প্রকাশ করায় লর্ড কার্জন ভারতে ভাইসর হয়ে আসলে তিনি বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব করেন। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। ১৯০৪ সালে ১৭ জানুয়ারী ফরিদপুরের একসভা অনুষ্ঠিত হয় অম্বিকাচরণের সভাপতিত্বে। সভা শেষে একটি সমিতি গঠিত হয়, সমিতির সদস্য মথুরানাথ মৈত্র, পুর্নচন্ত্র মৈত্র, জগদ্বন্ধু ভদ্র, উমা চরণ আচার্য, কামিনী কুমার মুখোপাধ্যায়, আসাদুজ্জামান ও অম্বিকাচরণ নিজে। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বাংলাকে বিভক্ত করেন। বাংলার একভাগে আসামের সঙ্গে যুক্ত করা হলো। বাঙ্গালিরা প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠল। শুরু হলো বঙ্গভঙ্গ বিরোধী তীব্র আন্দোলন। নেতৃত্বে ছিলেন স্যার সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, এক অসাধারণ বাগ্মী। এই নেতা সারা দেশের কাছে অবিভক্ত ভারতবাসীর মুক্তিদাতা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তাকে বলা হতো বাংলার মুকুটহীন সম্রাট। তার সুযোগ্য শিষ্য অম্বিকাচরণ ছিলেন গুরুর মত অসাধারণ বাগ্মী। তিনি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে ফরিদপুরের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। জাতীয় নেতার মত দাঁড়ালেন গুরুর পাশে। পরিচিতি লাভ করেন জাতীয় নেতা হিসাবে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে অস্বীকার করা হলো। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে তরুণ যুবক দল ‘বন্দে মাতরম’ গান গেয়ে রাখীবন্ধন উৎসবে মেতে উঠল। অপরাহ্নে ফেডারেশন হলের একটি ভিত্তি স্থাপন উপলক্ষ্যে বিরাট জনসমাগম ঘটে। এই সময় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গুরুদাস বন্দোপাধ্যায় প্রমুখের মত ব্যক্তিত্বের শুভাগমন ঘটে। সভা শেষে সুরেন্দ্র নাথ অম্বিকাচরণ মজুমদার আশুতোষ চৌধুরী, জে চৌধুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ কোলকাতার রাজপথে নগ্ন পায়ে শোভাযাত্রা আরম্ভ করেন। বঙ্গভঙ্গ তাকে এতটাই পীড়া দিয়েছিল যে, তিনি শপথ করেছিলেন বঙ্গভঙ্গ রদ না হলে তিনি পৈত্রিক ভিটামাটি বিক্রি করে পশ্চিমবঙ্গে বসবাস শুরু করবেন। ফরিদপুরে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন- এ তিনি পুরধা নেতা; এই আন্দোলনের কোন এক সময় তদানিন্তন ছোট লাট ফরিদপুরে আসলে অম্বিকাচরণের নির্দেশে রেলওয়ে ষ্টেশনে একটি কুলিও ছিল না, তারা ধর্মঘটে নেমেছিলো। বোমার বিস্ফোরণ ঘটেছিল সে সময়ে বড় লাটের লট বহন করেছিলো তার কর্মচারীরা। এরপর স্বদেশী আন্দোলকে কেন্দ্র করে কংগ্রেসে চরমপন্থীদের উত্থান ঘটে। ১৯০৬ সালে অম্বিকাচরণ বরিশাল প্রাদেশিক সমিতির অধিবেশনে স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান। ১৯০৭ সালে স্বদেশী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সুরাগ নামক স্থানে অধিবেশনে উদারপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যকার বিরোধ তীব্রতর হয়ে ওঠে। ফলে কংগ্রেস দ্বিধী বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই সম্মেলনে চরমপন্থীরা পরাজিত হলে তাদের প্রভাবে বাংলা ও পাঞ্জাবে সন্ত্রাসবাদের উদ্ভব ঘটে। স্বদেশী আন্দোলনকে সুষ্ঠুভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ফরিদপুরে অম্বিকাচরণ মজুমদারকে সভাপতি করে ফরিদপুর জেলা কমিটি গঠিত হয়। তার নেতৃত্বে ফরিদপুরে এই আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনে রুপ পরিগ্রহ করে। তখন অম্বিকাচরণের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি বৃহৎ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সম্মেলন প্রধান ছিলেন ব্রহ্ম ঘোষ, ফরিদপুরের সমগ্র জেলা ব্যাপী আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়; সতীশ মজুমদার, যোগেশ চক্রবর্তী অম্বিকাচরণকে সহযোগিতা করে স্বদেশী আন্দোলনের গতিবেগ বৃদ্ধি করে। ১৯০৬ সালে ২৮ জানুয়ারী মাদারীপুরে হবিগঞ্জে গোলাম মওলা চৌধরীর বাসভবনে শশধর তর্কচূড়ামনির সভাপতিত্বে একটি বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব গৃহীত হয়। ঐ সালে পুনরায় ফরিদপুরে প্রাদশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী প্রস্তাব উত্থাপন করে অনাথ বন্ধু গুহ। এই সম্মেলনে অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে- কৃষ্ণদাষ রায় ও অম্বিকাচরণ মজুমদার। এই সম্মেলনে কোলকাতা থেকে সুরেন্দ্র নাথ বন্দোপাধ্যায়সহ অনেকেই যোগদান করেন। এখানে অম্বিকাচরণ বঙ্গভঙ্গের উপরে জোরালো বক্তব্য দেন এবং বঙ্গভঙ্গ রদ না হলে ভারতে আগুন জ্বলে উঠবে বলে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন। ১৯১০ সালে কোলকাতার বঙ্গীয় প্রাদেশিক সমিতির বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে অম্বিকাচরণ এতে সভাপতিত্ব করেন। সম্মেলনে ভুপেন বসু, অম্বিকাচরণের বিবিধ গুণাবলি প্রশংসা করে বক্তৃতা দেন। সেই বক্তৃতায় তিনি অম্বিকাচরণের মাতৃভক্তির প্রতি ও দেশ প্রেমের –অসীম ত্যাগের বিশদ বর্ণনা দিয়ে জনগণকে উদ্ধুদ্ধ করেন। ৩ দিন এই সম্মেলন চলে। স্বদেশী আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে অম্বিকাচরণও বক্তৃতা দেয়। ১৯১১ সালে ফরিদপুর যে বঙ্গীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তার নাম দেওয়া হয় The United Bangal Provincial Conference. বঙ্গ তখনও রদ হয়নি। ১৯১৬ সালে লাক্ষ্ণৌতে কংগ্রেসের জাতীয় অধিবেশনে সভাপতি পদে দুইজন প্রার্থী ছিলেন অম্বিকাচরণ ও এ্যানী বেশান্ত। অম্বিকাচরণ ভোটে এ্যানী বেশান্তকে পরাজিত কের ঐতিহাসিক লাক্ষ্মৌতে কংগ্রেসের জাতীয় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। এ্যানী বেশান্ত ছিলেন একজন ইংরেজ মহিলা। তিনি কংগ্রেসে যোগদান করে আন্দোলনকে বেগবান করেন। এই অধিবেশনে উদারপন্থী ও চরমপন্থীরা ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ায় অম্বিকাচরণের উপর সন্তোষ প্রকাশ করেন। ১৯১৭ সালে পুনরায় কংগ্রেসের অধিবেশন হয় কোলকাতায়। এই অধিবেশনে উদারপন্থী ও চরমপন্থীদের পুর্নমিলন ঘটে। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যা লাক্ষ্মৌ প্যাক্ট নামে খ্যাত। বলা বাহুল্য, মুসলিম লীগের সাথে কংগ্রেসের সংযোগের চেষ্টা সেই সময় থেকে এই প্রথম এই ঐতিহাসিক অধিবেশনে সভাপতি হিসেবে অম্বিকাচরণ গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দান করেন। সেদিনের লাক্ষ্মৌতে ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার ডাক ছিল ধারনার বাইরে। সেই প্রেক্ষাপটে অম্বিকাচরণের স্বায়িত্ব শাসনের দাবীও ছিল সময়োচিত। তিনি বিচার ও শাসন বিভাগ পৃথকীকরণ সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি অধিবেশনে ভারত রক্ষা আইনের সমালোচনা করে জাতীয় সেনা বাহিনী গঠনের প্রস্তাব দেন। সম্মেলনে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবের সাথে আরও ছিল স্বায়ত্ব-শাসনের জন্য প্রচারকার্য পরিচালনা, শিক্ষা ক্ষেত্রে অধিক ভারতীয়দের নিয়োগ ও জুরীর বিচারে জুরীর সংখ্যা অর্ধেক পরিমাণ গ্রহণ ও স্বদেশী আন্দোলন সমর্থন। তিনি ১৮৮৫ সাল থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের নীতি অনুযায়ী ইংরেজদের সহযোগিতা করে কংগ্রেসের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এই দীর্ঘ সময় ধনে মধ্যপন্থীরা কংগ্রেস পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯১৬ সাল পর্যন্ত এই কংগ্রেসের প্রধান ছিলেন স্যার সুরেন্দ্রনাথ। জাতীয় কংগ্রেসের জনক হিসেবে আর অম্বিকাচরণ ছিলেন তার দক্ষিণহস্ত। ১৯১৭ ও ১৯১৮ সালে অম্বিকাচরণ আইন সভার “Legislative Council” এর সদস্য ছিলেন। তিনি আইন সভায় আলোচনায় অংশ গ্রহণ করে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। তার চেষ্টায় ১৯১৯ সালে ফরিদপুর জুরীর দ্বারা বিচার প্রথা প্রচলিত হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯১৭ সাল থেকে সুরেন্দ্রনাথের রাজনীতিতে ভাটা পড়ে। এসময় উদারপন্থীতে হাত থেকে কর্তৃত্ব চরমপন্থীদের হাতে চলে যেতে থাকে। অম্বিকাচরণের রাজনৈতিক জীবনের অধ্যায়ও শেষ হয়ে যায়।

১৯২০ সালে তিনি রাজেন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি জেলা বোর্ড, ফরিদপুর মিউনিসিপেলেটির প্রভুত সংস্কার সাধন করেন এবং প্রশংসিত হন। এছাড়াও তিনি স্কুল, কলেজ, অডিটোরিয়াম প্রতিষ্ঠা করে সুনাম অর্জন করেন। উনবিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রথম যুগের এই সিংহপুরুষ সর্বভারতীয় রাজনৈতিক ইতিহাসে যেমন স্মরনীয় তেমনি ফরিদপুর জেলার রাজনৈতিক গগণেও সমান আলোকিত মানুষ, শীর্ষ ব্যক্তিদের অন্যতম। উত্তরসূরীদের প্রেরণার উৎস এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আজও যশ্বষী হয়ে আছেন। ১৯২২ সালে এই মনীষীর জীবনাবসান ঘটে। [সূত্রঃ ফরিদপুরের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ইতিহাস- আনোয়ার করিম]

Last updated at 1 second ago


www.priofaridpur.com


Friday, 10th May 2024

© www.priofaridpur.com

Our Facebook Group

Email:-priofaridpur@gmail.com

This Application Developed by Visual Art