ফরিদপুর জেলার সাহিত্য সংস্কৃতি
সৃষ্টির পর থেকেই পৃথিবীর সব মানব গোষ্ঠিই তাদের নিজ নিজ কামনা-বাসনা, চাওয়া-পাওয়া, ব্যথা-বেদনা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিরহ প্রকাশ করে আসছে। ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর আচার আচরণ ভাব এবং কর্ম ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় এবং ভাষায় প্রকাশ করাই হচ্ছে তাদের সংস্কৃতি। যে জাতির ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি যত সমৃদ্ধ সে জাতি তত সমৃদ্ধ। আমরা বাঙালী হিসাবে আমাদের অতীত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। লোক সংস্কৃতি বাংলা সাহিত্যের একটি বিশাল ভান্ডার।
ফরিদপুর একটি সুপ্রাচীন জনপদ। ফরিদপুরের নিজস্ব সংস্কৃতিও এক্ষেত্রে উল্লেখ করার মত। লোকগীতি, লোকসংগীতি, পল্লীগীতি, বাউল গানের বিখ্যাত মরমী লোক কবি ও চারণ কবিদের লালন ক্ষেত্র এ ফরিদপুরে। এ জেলার অনুকুল আবহাওয়া ও পরিবেশ এদের লালন করেছে আর যুগে যুগে উপাদান ও উপকরণ সরবরাহ করে মরমী ও লোক কবিদের সাধনা ক্ষেত্রে অনুপ্রেরনা যুগিয়েছে। পল্লী কবি জসীমউদ্দিন, তাইজদ্দিন ফকির, দেওয়ান মোহন, দরবেশ কেতাবদি শাহ, ফকির তীনু শাহ, আজিম শাহ, হাজেরা বিবি, বয়াতি আসাদুজ্জামান, আবদুর রহমান চিশতী, আঃ জালাল বয়াতি, ফকির আব্দুল মজিদ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
ফরিদপুরের লোকগীতি ও লোকসঙ্গীত বৈচিত্রময়। উল্লেখযোগ্য লোকসঙ্গীত হলো বাউল, মুর্শিদী, মারফতী, ফকিরি, বিচার, ধুয়া, কবিগান, কীর্ত্তন, নৌকা বাইচের গান, ধান-পাট কাটার গান, সারি গান, মেয়েলি গান, হুলোই গান, নৈলা গান, অষ্টক গান, ভাটিয়ালি গান, ছাদ পিটানোর গান প্রভৃতি। মেছের সাঁই, কানাইলাল শীল, হালীম বয়াতি, ফিরোজা বেগম, মোঃ আসাফউদ্দৌলা, হাজেরা বিবি, ফকির আলমগীর প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের সংস্কৃতাঙ্গনে ফরিদপুরের লোকগানের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। এগুলোর প্রমান পাওয়া যায় মুহম্মদ মুনসুর উদ্দিনের ‘হারামনি’, বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত লোক সাহিত্য ও ফোকল্যের সংকলন সমূহ, আশুতোষ ভট্টাচার্যের বাংলার লোক সাহিত্য, উপেন্দ্রনাথ ভট্রাচার্যের বাংলার বাউল ও বাউল গান, ডঃ আশরাফ সিদ্দিকীর লোক সাহিত্য, জসীম উদদীনের জারীগান ও মুর্শিদী গান প্রভৃতি লোক গবেষনামূলক গ্রন্থে।
ফরিদপুরে যে সব কবি, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীগণ তাদের সৃষ্টিকর্ম দ্বারা ফরিদপুরের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে পল্লী কবি জসীম উদদীন, ঔপন্যাসিক রাজিয়া মজিদ , হাজেরা বিবি , আ ন ম বজলুর রশীদ , নাট্যকার নুরুল মোমেন , হুমায়ুন কবির , প্রেমাঙ্কুর আতর্থী , সুফী মোতাহার হোসেন , চারুচন্দ্র চক্রবর্তী , নরেন্দ্র নাথ মিত্র , হালিম বয়াতী, মৃনাল সেন, শিল্পী আসাফ উদ্দৌলাহ, মুন্সী মহিউদ্দিন , আ ন আবদুস সোবহান , ফকির আলমগীর , চিত্রশিল্পী কালিদাস কর্মকার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বিট্রিশ আমলে নির্মিত ফরিদপুর টাউন থিয়েটার হল ভবনটি ছিল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের এক ঐতিহাসিক মঞ্চ। কারন ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে কুইট ইন্ডিয়া আন্দলন শুরু হওয়ার প্রাক্কালে মুকুন্দ দাশের স্বদেশী গান ও যাত্রা এই মঞ্চে পরিবেশিত হয়। কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি গোলাম মোস্তফা, আব্বাস উদ্দিন, কবি জসীম উদদীন আবৃতি ও গান পরিবেশন করে উপস্থিত সকলকে বিমোহিত করেছেন। আবদুল্লাহ জহির উদ্দিন লাল মিয়া ও ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়ার উদ্যোগে যাদু সম্রাট পিসি সরকার এখানে যাদু প্রদর্শন করে ভুয়সী প্রশংসা অর্জন করেন। কিন্ত স্বাধীনতাত্তর এই মিলনায়তনটি সংস্কৃতির মঞ্চ থেকে সিনেমা হলে ভাড়া প্রদান করে কর্তৃপক্ষ। এরপর কবি জসীম উদ্দীন হল ফরিদপুর জেলার সাংস্কৃতিক মঞ্চ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে এবং বিভিন্ন সভা সেমিনারের পাশাপাশি এটি এখনও এখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এছাড়া শিল্পকলা একাডেমী মঞ্চ, ফরিদপুর পৌরসভার অম্বিকা হল, ফরিদপুর হাই স্কুল মিলনায়তন, নদী গবেষণা মিলনায়তনে অল্প পরিসরে মঞ্চ অনুষ্ঠানিদী হয়ে থাকে।
www.priofaridpur.com
Thursday, 21st November 2024